
পুঁই মাচা – পাঠ্য গদ্য
পুঁই মাচা
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
সহায়হরি চাটুজ্যে উঠানে পা দিয়াই স্ত্রীকে বলিলেন—একটা বড় বাটি কি ঘটি যা হয় কিছু দাও ততা, তারক খুড়ো গাছ কেটেছে, একটু ভাল রস আনি।
স্ত্রী অন্নপূর্ণা খড়ের রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া শীতকালের সকালবেলা নারিকেল তেলের বোতলে ঝাঁটার কাটি পুরিয়া দুই আঙুলের সাহায্যে ঝাঁটার কাটিলগ্ন জমানো তেলটুকু সংগ্রহ করিয়া চুলে মাখাইতে ছিলেন স্বামীকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি গায়ের কাপড় একটু টানিয়া দিলেন মাত্র, কিন্তু বাটি কি ঘটি বাহির করিয়া দিবার জন্য বিন্দুমাত্র আগ্রহ তো দেখাইলেন না, এমন কি বিশেষ কোনো কথাও বলিলেন না।
সহায়হরি অগ্রবর্তী হইয়া বলিলেন—কি হয়েছে, বসে রইলে যে? দাও না একটা ঘটি? আঃ, ক্ষেন্তি-টেন্তি সব কোথায় গেল এরা? তুমি তেল মেখে বুঝি ছোঁবে না?
অন্নপূর্ণা তেলের বোতলটি সরাইয়া স্বামীর দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া রহিলেন, পরে অত্যন্ত শান্ত সুরে জিজ্ঞাসা করিলেন—তুমি মনে মনে কি ঠাউরেছ বলতে পার?
স্ত্রীর অতিরিক্ত রকমের শান্ত সুরে সহায়হরির মনে ভীতির সঞ্চার হইল—ইহা যে ঝড়ের অব্যবহিত পূর্বের আকাশের স্থিরভাব মাত্র, তাহা বুঝিয়া তিনি মরীয়া হইয়া ঝড়ের প্রতীক্ষায় রহিলেন। একটু আমতা আমতা করিয়া কহিলেন—কেন…কি আবার…কি…
অন্নপূর্ণা পূর্বাপেক্ষাও শান্ত সুরে বলিলেন-দেখ, রঙ্গ কোরো না বলছি ন্যাকামি করতে হয় অন্য সময় কোরো। তুমি কিছু জান না, কি খোঁজ রাখ না? অত বড় মেয়ে যার ঘরে, সে মাছ ধরে আর রস খেয়ে দিন কাটায় কি করে তা বলতে পার? গাঁয়ে কি গুজব রটেছে জান?
সহায়হরি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—কেন? কি গুজব?
—কি গুজব জিজ্ঞাসা করো গিয়ে চৌধুরীদের বাড়ি। কেবল বাগদী দুলে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে জন্ম কাটালে ভদ্দরলোকের গাঁয়ে বাস করা যায় না। সমাজে থাকতে হলে সেই রকম মেনে চলতে হয়।
সহায়হরি বিস্মিত হইয়া কি বলিতে যাইতেছিলেন, অন্নপূর্ণা পূর্ববৎ সুরেই পুনর্বার বলিয়া উঠিলেন—একঘরে করবে গো, তোমাকে একঘরে করবে কাল চৌধুরীদের চণ্ডীমণ্ডপে এসব কথা হয়েছে। আমাদের হাতে ছোঁয়া জল আর কেউ খাবে না আশীর্বাদ হয়ে মেয়ের বিয়ে হলো না—ও নাকি উচ্ছ্বগগু করা মেয়ে—গাঁয়ের কোন কাজে তোমাকে আর কেউ বলবে না— যাও ভালোই হয়েছে তোমার। এখন গিয়ে দুলে-বাড়ী বাগদী-বাড়ী উঠে-বসে দিন কাটাও
সহায়হরি তাচ্ছিল্যের ভাব প্রকাশ করিয়া বলিলেন—এই! আমি বলি, না জানি কি ব্যাপার। একঘরে! সবাই একঘরে করেছেন, এবার বাকি আছেন কালীময় ঠাকুর!—ওঃ!
অন্নপূর্ণা তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া উঠিলেন—কেন, তোমাকে একঘরে করতে বেশি কিছু লাগে। নাকি? তুমি কি সমাজের মাথা, না একজন মাতব্বর লোক? চাল নেই, চুলো নেই, এক কড়ার মুরোদ নেই, চৌধুরীরা তোমায় একঘরে করবে তা আর এমন কঠিন কথা কি?—আর সত্যিই তো, এদিকে ধাড়ী মেয়ে হয়ে উঠল। হঠাৎ স্বর নামাইয়া বলিলেন—হলো যে পনেরো বছরের, বাইরে কমিয়ে বলে বেড়ালে কি হবে, লোকের চোখ নেই?…পুনরায় গলা উঠাইয়া বলিলেন—না বিয়ে দেবার গা, না কিছু। আমি কি যাব পাত্তর ঠিক করতে?
সশরীরে যতক্ষণ স্ত্রীর সম্মুখে বর্তমান থাকিবেন, স্ত্রীর গলার সুর ততক্ষণ কমিবার কোনো সম্ভাবনা নাই বুঝিয়া সহায়হরি দাওয়া হইতে তাড়াতাড়ি একটি কাঁসার বাটি উঠাইয়া লইয়া খিড়কী দুয়ার লক্ষ করিয়া যাত্রা করিলেন—কিন্তু খিড়কী দুয়ারের একটু এদিকে কি দেখিয়া হঠাৎ থামিয়া গেলেন এবং আনন্দপূর্ণস্বরে বলিয়া উঠিলেন—এ সব কি রে! ক্ষেন্তি মা, এসব কোথা থেকে আনলি? ওঃ! এ যে…
চোদ্দ-পনেরো বছরের একটি মেয়ে আর-দুটি ছোট ছোট মেয়ে পিছনে লইয়া বাড়ী ঢুকিলা তাহার হাতে এক বোঝা পুঁই শাক, ডাঁটাগুলি মোটা ও হলদে, হলদে চেহারা দেখিয়া মনে হয় কাহারা পাকা পুঁই-গাছ উপড়াইয়া ফেলিয়া উঠানের জঙ্গল তুলিয়া দিতেছিল, মেয়েটি তাহাদের উঠানের জঞ্জাল প্রাণপণে তুলিয়া আনিয়াছে। ছোট মেয়ে দুটির মধ্যে একজনের হাত খালি, অপরটির হাতে গোটা দুই-তিন পাকা পুঁই-পাতা জড়ানো কোনো দ্রব্য।
বড় মেয়েটি খুব লম্বা, গোলগাল চেহারা, মাথার চুলগুলো কৃষ্ণ ও অগোছালো বাতাসে উড়িতেছে, মুখোনা খুব বড়, চোখ দু’টো ডাগর ডাগর ও শান্তা সরু সরু কাঁচের চুড়িগুলো দু’পয়সা ডজনের একটি সেফটিপিন দিয়া একত্র করিয়া আটকানো। পিনটির বয়স খুঁজিতে যাইলে প্রাগৈতিহাসিক যুগে গিয়া পড়িতে হয় এই বড় মেয়েটির নামই বোধ হয় ক্ষেন্তি, কারণ সে তাড়াতাড়ি পিছন ফিরিয়া তাহার পশ্চাদ্বর্তিনীর হাত হইতে পুঁই পাতা জড়ানো দ্রব্যটি লইয়া মেলিয়া ধরিয়া বলিল—চিংড়ি মাছ, বাবা। গয়া বুড়ীর কাছ থেকে রাস্তায় নিলাম, দিতে চায় না, বলে—তোমার বাবার কাছে আর-দিনকার দরুন দু’টো পয়সা বাকি আছে আমি বললাম—দাও গয়া পিসী, আমার বাবা কি তোমার দু’টো পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাবে—আর এই পুঁই শাকগুলো ঘাটের ধারে রায় কাকা দিয়ে বললে, নিয়ে যা—কেমন মোটা মোটা…
অন্নপূর্ণা দাওয়া হইতেই অত্যন্ত ঝাঁজের সহিত চিকার করিয়া উঠিলেন—নিয়ে যা, আহা কি অমর্তই তোমাকে তারা দিয়েছে! পাকা পুঁইডাঁটা কাঠ হয়ে গিয়েছে, দু’দিন পরে ফেলে দিত…নিয়ে যা, আর উনি তাদের আগাছা উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন—ভালোই হয়েছে, তাদের আর। নিজেদের কষ্ট করে কাটতে হলো না! যত পাথুরে বোকা সব মরতে আসে আমার ঘাড়ে…ধাড়ী। মেয়ে, বলে দিয়েছি না তোমায় বাড়ীর বাইরে কোথাও পা দিও না? লজ্জা করে না এ-পাড়া সে পাড়া করে বেড়াতে! বিয়ে হলে যে চার ছেলের মা হতে? খাওয়ার নামে আর জ্ঞান থাকে না, না?…কোথায় শাক, কোথায় বেগুন আর একজন বেড়াচ্ছেন কোথায় রস, কোথায় ছাই, কোথায় পাঁশ,…ফেল বলছি ওসব…ফেলা।
মেয়েটি শান্ত অথচ ভয়মিশ্রিত দৃষ্টিতে মা’র দিকে চাহিয়া হাতের বাঁধন আলগা করিয়া দিল, পুঁই শাকের বোঝা মাটিতে পড়িয়া গেল। অন্নপূর্ণা বকিয়া চলিলেন—যা তো রাধী, ও আপদগুলো টেনে খিড়কীর পুকুরের ধারে ফেলে দিয়ে আয় তো…ফের যদি বাড়ীর বার হতে দেখেছি, তবে ঠ্যাং খোঁড়া না করি তো…।
বোঝা মাটিতে পড়িয়া গিয়াছিল। ছোট মেয়েটি কলের পুতুলের মতন সেগুলি তুলিয়া লইয়া খিড়কী অভিমুখে চলিল, কিন্তু ছোট মেয়ে অতবড় বোঝা আঁকড়াইতে পারিল না, অনেকগুলি ডাঁটা এদিকে ওদিকে ঝুলিতে ঝুলিতে চলিল …সহায়হরির ছেলেমেয়েরা তাহাদের মাকে অত্যন্ত ভয় করিত।
সহায়হরি আমতা করিয়া বলিতে গেলেন—তা এনেছে ছেলেমানুষ খাবে বলে…তুমি আবার…বরং…
পুঁইশাকের বোঝা লইয়া যাইতে যাইতে ছোট মেয়েটি ফিরিয়া দাঁড়াইয়া মার মুখের দিকে চাহিল। অন্নপূর্ণা তাহার দিকে চাহিয়া বলিলেন না না, নিয়ে যা, খেতে হবে না—মেয়েমানুষের আবার অত নোলা কিসের! এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় নিয়ে আসবে দুটো পাকা পুঁইশাক ভিক্ষে করে! যা, যা…তুই যা, দূর করে বনে দিয়ে আয়…।
সহায়হরি বড় মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তাহার চোখ দু’টা জলে ভরিয়া আসিয়াছে। তাঁর মনে বড় কষ্ট হইল। কিন্তু মেয়ের যতই সাধের জিনিস হোক, পুঁই শাকের পক্ষাবলম্বন করিয়া দুপুরবেলা স্ত্রীকে চটাইতে তিনি আদৌ সাহসী হইলেন না—নিঃশব্দে খিড়কী দোর দিয়া বাহির হইয়া গেলেন।
বসিয়া রাঁধিতে রাঁধিতে বড় মেয়ের মুখের কাতর দৃষ্টি স্মরণে পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে অন্নপূর্ণার মনে পড়িল—গত অরন্ধনের পূর্বদিন বাড়ীতে পুঁই শাক রান্নার সময় ক্ষেন্তি আবদার করিয়া বলিয়াছিল—মা, অর্ধেকগুলো কিন্তু একা আমার, অর্ধেক সব মিলে তোমাদের…
বাড়ীতে কেহ ছিল না, তিনি নিজে গিয়া উঠানের ও খিড়কী দোরের আশেপাশে যে ডাঁটা পড়িয়াছিল, সেগুলি কুড়াইয়া লইয়া আসিলেন—বাকিগুলা কুড়ানো যায় না, ডোবার ধারে ছাইগাদায় ফেলিয়া দিয়াছে। কুচো চিংড়ি দিয়া এইরূপে চুপিচুপিই পুঁইশাকের তরকারী রাঁধিলেন।
দুপুরবেলা ক্ষেন্তি পাতে পুঁইশাকের চচ্চড়ি দেখিয়া বিস্ময় ও আনন্দপূর্ণ ডাগর চোখে মায়ের দিকে ভয়ে ভয়ে চাহিল। দু-এক বার এদিকে ওদিকে ঘুরিয়া আসিতেই অন্নপূর্ণা দেখিলেন উক্ত পুঁইশাকের একটুকরাও তাহার পাতে পড়িয়া নাই। পুঁইশাকের উপর তাঁহার এই মেয়েটির কিরূপ লোভ তাহা তিনি জানিতেন, জিজ্ঞাসা করিলেন—কিরে ক্ষেন্তি, আর একটু চচ্চড়ি দিই? ক্ষেন্তি তৎক্ষণাৎ ঘাড় নাড়িয়া এ আনন্দজনক প্রস্তাব সমর্থন করিলা কি ভাবিয়া অন্নপূর্ণার চোখে জল আসিল, চাপিতে গিয়া তিনি চোখ উঁচু করিয়া চালের বাতায় গোঁজা ডালা হইতে শুকনা লঙ্কা পাড়িতে লাগিলেন।
কালীমায়ের চণ্ডীমণ্ডপে সেদিন বৈকাল বেলা সহায়হরির ডাক পড়িল। সংক্ষিপ্ত ভূমিকা ফাঁদিবার পর কালীময় উত্তেজিত সুরে বলিলেন—সে-সব দিন কি আর আছে ভায়া? এই ধর, কেষ্ট মুখুয্যে…স্বভাব নইলে পাত্র দেব না, স্বভাব নইলে পাত্র দেব না করে কি কাণ্ডটাই করলে— অবশেষে কিনা হরির ছেলেটাকে ধরে প’ড়ে মেয়ের বিয়ে দেয়, তবে রক্ষো তারা কি স্বভাব? রাম বল, ছ-সাত পুরুষে ভঙ্গ, পচা শ্রোত্রিয়! পরে সুর নরম করিয়া বলিলেন—তা সমাজের সে-সব শাসনের দিন কি আর আছে? দিন দিন চলে যাচ্ছে। বেশি দূর যাই কেন, এই যে তোমার মেয়েটি তেরো বছরের…
সহায়হরি বাধা দিয়া বলিতে গেলেন—এই শ্রাবণে তেরোয়…
–আহা-হা, তেরোয় আর মোলোয় তফাৎ কিসের শুনি? তেরোয় আর মোলোয় তফাৎটা কিসের? আর সে তেরোই হোক, চাই যোলোই হোক, চাই পঞ্চাশই হোক, তাতে আমাদের দরকার নেই, সে তোমার হিসেব তোমার কাছে। কিন্তু পাত্তর আশীর্বাদ হয়ে গেল, তুমি বেঁকে বসলে কি জন্যে শুনি? ও তো একরকম উচ্ছগগু করা মেয়ে। আশীর্বাদ হওয়াও যা বিয়ে হওয়াও তা, সাত পাকের যা বাকি, এই তো?…সমাজে বসে এ-সব কাজগুলো তুমি যে করবে আর আমরা বসে বসে দেখব এ তুমি মনে ভেবো না। সমাজের বামুনদের যদি জাত মারবার ইচ্ছে না থাকে, মেয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত করে ফেল…পাত্তর পাত্তর, রাজপুত্তুর না হলে পাত্তর মেলে না? গরীব মানুষ, দিতে-থুতে পারবে না বলেই শ্ৰীমন্ত মজুমদারের ছেলেকে ঠিক করে দিলাম। লেখাপড়া নাই বা জানলো জজ মেজেস্টার না হলে কি মানুষ হয় না? দিব্যি বাড়ী বাগান পুকুর, শুনলাম এবার নাকি কুঁড়ির জমিতে চাট্টি আমন ধানও করেছে, ব্যস—রাজার হাল! দুই ভায়ের অভাব কি?…
ইতিহাসটা হইতেছে এই যে, মণিগাঁয়ের উক্ত মজুমদার মহাশয়ের পুত্রটি কালীময়ই ঠিক করিয়া দেন। কেন কালীময় মাথাব্যথা করিয়া সহায়হরির মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ মজুমদার মহাশয়ের ছেলের সঙ্গে ঠিক করিতে গেলেন তাহার কারণ নির্দেশ করিতে যাইয়া কেহ কেহ বলেন যে, কালীময় নাকি মজুমদার মহাশয়ের কাছে অনেক টাকা ধারেন, অনেকদিনের সুদ পর্যন্ত বাকি—শীঘ্র নালিশ হইবে, ইত্যাদি। এ গুজব যে শুধু অবান্তর তাহাই নহে, ইহার কোন ভিত্তি আছে বলিয়াও মনে হয় না। ইহা দুষ্ট পক্ষের রটনা মাত্র। যাহাই হোক পাত্রপক্ষ আশীর্বাদ করিয়া যাওয়ার দিন কতক পরে সহায়হরি টের পান পাত্রটি কয়েক মাস পূর্বে নিজের গ্রামে কি একটা করিবার ফলে গ্রামের এক কুম্ভকারবধূর আত্মীয়-স্বজনের হাতে বেদম প্রহার খাইয়া কিছুদিন নাকি শয্যাগত ছিল। এ রকম পাত্রে মেয়ে দিবার প্রস্তাব মনঃপূত না হওয়ায় সহায়হরি সে সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া দেন।
দিন দুই পরের কথা। সকালে উঠিয়া সহায়হরি উঠানে বাতাবী লেবু গাছের ফাঁক দিয়া যেটুকু নিতান্ত কচি রাঙা রৌদ্র আসিয়াছিল তাহারই আতপে বসিয়া আপন মনে তামাক টানিতেছেনা। বড় মেয়ে ক্ষেন্তি আসিয়া চুপি চুপি বলিল—বাবা, যাবে না?মা ঘাটে গেল…।
সহায়হরি একবার বাড়ীর পাশে ঘাটের পথের দিকে কি জানি কেন চাহিয়া দেখিলেন, পরে নিম্নস্বরে বলিলেন—যা শিগগির, শাবলখানা নিয়ে আয় দিকি! কথা শেষ করিয়া তিনি উৎকণ্ঠার সহিত জোরে জোরে তামাক টানিতে লাগিলেন। এবং পুনরায় একবার কি জানি কেন খিড়কীর দিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। ইতিমধ্যে প্রকাণ্ড ভারী একটা লোহার শাবল দুই হাত দিয়া আঁকড়াইয়া ধরিয়া ক্ষেন্তি আসিয়া পড়িল—তৎপরে পিতা-পুত্রীতে সন্তর্পণে সম্মুখের দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল—ইহাদের ভাব দেখিয়া মনে হইতেছিল ইহারা কাহারো ঘরে সিঁধ দিবার উদ্দেশ্যে চলিয়াছে।
অন্নপূর্ণা স্নান করিয়া সবে কাপড় ছাড়িয়া উনুন ধরাইবার যোগাড় করিতেছেন—মুখুয্যে বাড়ীর ছোট খুকী দুর্গা আসিয়া বলিল—খুড়ীমা, মা বলে দিলে খুড়ীমাকে গিয়ে বল, মা ছোঁবে না তুমি আমাদের নবান্নটা মেখে আর ইতুর ঘটগুলো বার করে দিয়ে আসবে?
মুখুয্যে বাড়ী ও-পাড়ায়—যাইবার পথের বাঁ ধারে এক জায়গায় শেওড়া, বনভাঁট, রাংচিতা, বনচালতা গাছের ঘন বন শীতের সকালে এক প্রকার লতাপাতার ঘন গন্ধ বন হইতে বাহির হইতেছিলা একটা লেজঝোলা হলদে পাখী আমড়া গাছের এ-ডাল হইতে ও-ডালে যাইতেছে।।
দুর্গা আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল—খুড়ীমা, খুড়ীমা, ঐ যে কেমন পাখীটা। পাখী দেখিতে গিয়া অন্নপূর্ণা কিন্তু আর একটা জিনিস লক্ষ্য করিলেন। ঘন বনটার মধ্যে কোথায় এতক্ষণ খুপ খুপ করিয়া আওয়াজ হইতেছিল…কে যেন কি খুঁড়িতেছে…দুর্গার কথার পরেই হঠাৎ সেটা বন্ধ হইয়া গেল। অন্নপূর্ণা সেখানে খানিকক্ষণ থমকিয়া দাঁড়াইলেন, পরে চলিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার খানিকদূর যাইতে বনের মধ্যে পুনরায় খুপ খুপ শব্দ আরম্ভ হইল।
কাজ করিয়া ফিরিতে অন্নপূর্ণার কিছু বিলম্ব হইল। বাড়ী ফিরিয়া দেখিলেন, ক্ষেন্তি উঠানের রৌদ্রে বসিয়া তেলের বাটি সম্মুখে লইয়া খোঁপা খুলিতেছে। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন—এখনও নাইতে যাসনি যে, কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
ক্ষেন্তি তাড়াতাড়ি উত্তর দিল—এই যে যাই মা, এক্ষুনি যাব আর আসব।
ক্ষেন্তি স্নান করিতে যাইবার একটুখানি পরেই সহায়হরি সোৎসাহে পনেরো-ষোল সের ভারী একটা মেটে আলু ঘাড়ে করিয়া কোথা হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং সম্মুখে স্ত্রীকে দেখিয়া কৈফিয়তের দৃষ্টিতে সেই দিকে চাহিয়াই বলিয়া উঠিলেন—ওই ও-পাড়ার ময়শা চৌকিদার রোজই বলে—কর্তা-ঠাকুর, তোমার বাপ থাকতে তবু মাসে মাসে এদিকে তোমাদের পায়ের ধুলো পড়ত, তা আজকাল তো তোমরা আর আস না, এই বেড়ার গায়ে মেটে আলু করে রেখেছি, তা দাদাঠাকুর বরং…
অন্নপূর্ণা স্থির দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চাহিয়া বলিলেন—বরোজপোতার বনের মধ্যে বসে খানিক আগে কি করছিলে শুনি?
সহায়হরি অবাক হইয়া বলিলেন—আমি। না…আমি কখন?…কক্ষনো না, এই তো আমি… সহায়হরির ভাব দেখিয়া মনে হইতেছিল তিনি এইমাত্র আকাশ হইতে পড়িয়াছেন।
অন্নপূর্ণা পূর্বের মতনই স্থির দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চাহিয়া বলিলেন—চুরি তো করবেই, তিন কাল গিয়েছে এক কাল আছে, মিথ্যা কথাগুলো আর এখন বোলো না। আমি সব জানি। মনে ভেবেছিলে আপদ ঘাটে গিয়েছে আর কি…দুর্গার মা ডেকে পাঠিয়েছিল, ও-পাড়ায় যাচ্ছি, শুনলাম বরোজপোতার বনের মধ্যে কি সব খুপ খুপ শব্দ…তখনি আমি বুঝতে পেরেছি, সাড়া পেয়ে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল, যেই আবার খানিকদূর গেলাম আবার দেখি শব্দ…তোমার তো ইহকালও নেই পরকালও নেই, চুরি করতে, ডাকাতি করতে, যা করতে ইচ্ছে হয় কর কিন্তু মেয়েটাকে আবার এর মধ্যে নিয়ে গিয়ে ওর মাথা খাওয়া কিসের জন্যে?
সহায়হরি হাত নাড়িয়া, বরোজপোতায় তাঁহার উপস্থিত থাকার বিরুদ্ধে কতকগুলি প্রমাণ উত্থাপন করিবার চেষ্টা করিতে গেলেন, কিন্তু স্ত্রীর চোখের দৃষ্টির সামনে তাঁহার বেশি কথাও যোগাইল না, বা কথিত উক্তিগুলির মধ্যে কোন পৌর্বাপর্য সম্বন্ধও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না …
আধ ঘণ্টা পরে ক্ষেন্তি স্নান সারিয়া বাড়ী ঢুকিলা সমুখস্থ মেটে আলুর দিকে একবার আড়চোখে চাহিয়াই নিরীহমুখে উঠানের আলনায় অত্যন্ত মনোযোগের সহিত কাপড় মেলিয়া দিতেছিল।
অন্নপূর্ণা ডাকিলেন—ক্ষেন্তি, এদিকে একবার আয় তো, শুনে যা…
মায়ের ডাক শুনিয়া ক্ষেন্তির মুখ শুকাইয়া গেল—সে ইতস্তত করিতে করিতে মা’র নিকটে আসিলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন—এই মেটে আলুটা দু’জনে মিলে তুলে এনেছিস, না?
ক্ষেন্তি মা’র মুখের দিকে একটুখানি চাহিয়া থাকিয়া একবার ভূপতিত মেটে আলুটার দিকে চাহিল, পরে পুনরায় মা’র মুখের দিকে চাহিল এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে একবার বাড়ীর সম্মুখস্থ বাঁশঝাড়ের মাথার দিকেও চাহিয়া লইল তাহার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল, কিন্তু মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না।
অন্নপূর্ণা কড়া সুরে বলিলেন—কথা বলছিস নে যে বড়? এই মেটে আলু তুই এনেছিস কি না? ক্ষেন্তি বিপন্ন চোখে মা’র মুখের দিকেই চাহিয়া ছিল, উত্তর দিল—হ্যাঁ।
অন্নপূর্ণা তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া উঠিয়া বলিলেন—পাজী, আজ তোমার পিঠে আমি আস্ত কাঠের চেলা ভাঙব তবে ছাড়ব, বরোজপোতার বনে গিয়েছে মেটে আলু চুরি করতে! সোমত্ত মেয়ে, বিয়ের যুগ্যি হয়ে গেছে কোন কালে, সেই একগলা বিজন বন, যার মধ্যে দিনদুপুরে বাঘ লুকিয়ে থাকে, তার মধ্যে থেকে পরের আলু নিয়ে এল তুলে? যদি গোঁসাইরা চৌকিদার ডেকে তোমায় ধরিয়ে দেয়? তোমার কোন শ্বশুর এসে তোমায় বাঁচাত? আমার জোটে খাব, না জোটে না খাব, তা বলে পরের জিনিসে হাত? এ মেয়ে নিয়ে আমি কি করব মা?
দু-তিন দিন পরে একদিন বৈকালে, ধূলামাটি মাখা হাতে ক্ষেন্তি মাকে আসিয়া বলিল—মা মা, দেখবে এস…
অন্নপূর্ণা গিয়া দেখিলেন ভাঙ্গা পাঁচিলের ধারে যে ছোট খোলা জমিতে কতকগুলো পাথরকুচি ও কন্টিকারীর জঙ্গল হইয়াছিল, ক্ষেন্তি ছোট বোনটিকে লইয়া সেখানে মহা উৎসাহে তরকারির আওলাত করিবার আয়োজন করিতেছে এবং ভবিষ্যসম্ভাবী নানাবিধ কাল্পনিক ফলমূলের অগ্রদুত-স্বরূপ বর্তমানে কেবল একটিমাত্র শীর্ণকায় পুঁইশাকের চারা কাপড়ের ফালির গ্রন্থিবন্ধ হইয়া ফাঁসি হইয়া যাওয়া আসামীর মতন উধ্বমুখে একখণ্ড শুষ্ক কঞ্চির গায়ে ঝুলিয়া রহিয়াছে। ফলমূলাদির অবশিষ্টগুলি আপাতত তাঁর বড় মেয়ের মস্তিষ্কের মধ্যে অবস্থিতি করিতেছে, দিনের। আলোয় এখনও বাহির হয় নাই।
অন্নপূর্ণা হাসিয়া বলিলেন—দূর পাগলী, এখন পুঁই ডাঁটার চারা পোঁতে কখনন? বর্ষাকালে পুঁততে হয়। এখন যে জল না পেয়ে মরে যাবো।
ক্ষেন্তি বলিল—কেন, আমি রোজ জল ঢালব?
অন্নপূর্ণা বলিলেন—দেখ, হয়তো বেঁচে যেতেও পারে। আজকাল রাতে খুব শিশির হয়। খুব শীত পড়িয়াছে। সকালে উঠিয়া সহায়হরি দেখিলেন, তাঁহার দুই ছোট মেয়ে দোলাই গায়ে বাঁধিয়া রোদ উঠিবার প্রত্যাশায় উঠানের কাঁঠালতলায় দাঁড়াইয়া আছে। …একটা ভাঙা ঝুড়ি করিয়া ক্ষেন্তি শীতে কাঁপিতে কাঁপিতে মুখুয্যে বাড়ী হইতে গোবর কুড়াইয়া আনিলা সহায়হরি বলিলেন—হ্যাঁ মা ক্ষেন্তি, তা সকালে উঠে জামাটা গায়ে দিতে তোর কি হয়? দেখ দিকি, এই শীত?
—আচ্ছা দিচ্ছি বাবা—কই শীত, তেমন তো…
—হ্যাঁ, দে মা, এক্ষুনি দে—অসুখ-বিসুখ পাঁচ রকম হতে পারে, বুঝলি নে?—সহায়হরি বহির হইয়া গেলেন, ভাবিতে ভাবিতে গেলেন, তিনি কি অনেক দিন মেয়ের মুখে ভালো করিয়া চাহেন নাই? ক্ষেন্তির মুখ এমন সুশ্রী হইয়া উঠিয়াছে?…।
জামার ইতিহাস নিম্নলিখিত রূপা বহু বৎসর অতীত হইল, হরিপুরের রাসের মেলা হইতে সহায়হরি কালো সার্জের এই আড়াই টাকা মূল্যের জামাটি ক্রয় করিয়া আনেন। ছিড়িয়া যাইবার পর তাহাতে কতবার রিফু ইত্যাদি করা হইয়াছিল, সম্প্রতি গত বৎসর হইতে ক্ষেন্তির স্বাস্থ্যোন্নতি হওয়ার দরুন জামাটি তাহার গায়ে হয় না। সংসারের এসব খোঁজ সহায়হরি রাখিতেন না। জামার বর্তমান অবস্থা অন্নপূর্ণারও জানা ছিল না—ক্ষেন্তির নিজস্ব ভাঙ্গা টিনের তোরঙ্গের মধ্যে উহা থাকিত।
পৌষ সংক্রান্তি। সন্ধ্যাবেলা অন্নপূর্ণা একটি কাঁসিতে চালের গুঁড়া, ময়দা ও গুড় দিয়া চটকাইতে ছিলেন—একটা ছোট বাটিতে একবাটি তেল। ক্ষেন্তি কুরুনীর নীচে একটা কলার পাত পাড়িয়া এক থালা নারিকেল কুরিতেছে। অন্নপূর্ণা প্রথমে ক্ষেন্তির সাহায্য লইতে স্বীকৃত হন নাই, কারণ সে যেখানে সেখানে বসে, বনেবাদাড়ে ঘুরিয়া ফেরে, তাহার কাপড়চোপড় শাস্ত্রসম্মত ও শুচি নহে। অবশেষে ক্ষেন্তি নিতান্ত ধরিয়া পড়ায় হাত-পা ঘোয়াইয়া ও শুষ্ক কাপড় পরাইয়া তাহাকে বর্তমান পদে নিযুক্ত করিয়াছেন।
ময়দার গোলা মাখা শেষ হইলে অন্নপূর্ণা উনুনে খোলা চাপাইতে যাইতেছেন, ছোট মেয়ে রাধী হঠাৎ ডান হাতখানা পাতিয়া বলিল—মা, ঐ একটু…
অন্নপূর্ণা বড় গামলাটা হইতে একটুখানি গোলা তুলিয়া লইয়া হাতের আঙুল পাঁচটি দ্বারা একটি বিশেষ মুদ্রা রচনা করিয়া সেটুকু রাধীর প্রসারিত হাতের উপর দিলেন মেজমেয়ে পুঁটি অমনি ডান হাতখানা কাপড়ে তাড়াতাড়ি মুছিয়া লইয়া মা’র সামনে পাতিয়া বলিল—মা, আমায় একটু…
ক্ষেন্তি শুচিবস্ত্রে নারিকেল কুরিতে কুরিতে লুব্ধনেত্রে মধ্যে মধ্যে এদিকে চাহিতেছিল, এ সময় খাইতে চাওয়ায় মা পাছে বকে, সেই ভয়ে চুপ করিয়া রহিল।
অন্নপূর্ণা বলিলেন—দেখি, নিয়ে আয় ক্ষেন্তি ঐ নারকেল মালাটা, ওতে তোর জন্য একটু রাখি ক্ষেন্তি ক্ষিপ্র হস্তে নারিকেলের উপরের মালাখানা, যাহাতে ফুটা নাই, সেখানে সরাইয়া দিল, অন্নপূর্ণা তাহাতে একটু বেশি করিয়া গোলা ঢালিয়া দিলেন।
মেজমেয়ে পুঁটি বলিল—জেঠাইমারা অনেকখানি দুধ নিয়েছে, রাঙাদিদি ক্ষীর তৈরী করছিল, ওদের অনেক রকম হবে।
ক্ষেন্তি মুখ তুলিয়া বলিল—এ-বেলা আবার হবে নাকি? ওরা তো ও-বেলা ব্রাহ্মণ নেমন্তন্ন করেছিল সুরেশ কাকাকে আর ও-পাড়ার তিনুর বাবাকে। ও-বেলা তো পায়েস, ঝোল-পুলি, মুগতক্তি এইসব হয়েছে।
পুঁটি জিজ্ঞাসা করিল—হ্যাঁ মা, ক্ষীর নইলে নাকি পাটিসাপটা হয় না? খেদী বলছিল, ক্ষীরের পুর না হলে কি আর পাটিসাপটা হয়? আমি বললাম, কেন, আমার মা তো শুধু নারকেলের ছাঁই দিয়েই করে, সে তো কেমন ভালো লাগে।
অন্নপূর্ণা বেগুনের বোঁটায় একটুখানি তেল লইয়া খোলায় মাখাইতে মাখাইতে প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজিতে লাগিলেন।
ক্ষেন্তি বলিল—খেদীর ওই সব কথা! ঘেঁদীর মা তো ভারী পিঠে করে কিনা! ক্ষীরের পুর দিয়ে ঘিয়ে ভাজলেই কি আর পিঠে হলো? সেদিন জামাই এলে ওদের বাড়ী দেখতে গেলুম কিনা, তাই খুড়ীমা দু’খানা পাটিসাপটা খেতে দিলে, ওমা কেমন একটা ধরা-ধরা গন্ধ…আর পিঠেতে কখনো কোনো গন্ধ পাওয়া যায়? পাটিসাপটা ক্ষীর দিলে ছাই খেতে হয়!
বেপরোয়া ভাবে উপরোক্ত উক্তি শেষ করিয়া ক্ষেন্তি মা’র চোখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল —মা, নারকেলের কোরা একটু নেব?
অন্নপূর্ণা বলিলেন—নে, কিন্তু এখানে বসে খাস নো মুখ থেকে পড়বে না কি হবে, যা ঐদিকে যা।
ক্ষেন্তি নারকেলের মালায় এক থাবা তুলিয়া লইয়া একটু দুরে গিয়া খাইতে লাগিল। মুখ যদি মনের দর্পণ স্বরূপ হয়, তবে ক্ষেন্তির মুখ দেখিয়া সন্দেহের কোনো কারণ থাকিতে পারিত না যে, সে অত্যন্ত মানসিক তৃপ্তি অনুভব করিতেছে।
ঘণ্টাখানেক পরে অন্নপূর্ণা বলিলেন—ওরে, তোরা সব এক এক টুকরো পাতা পেতে বোস তো দেখি, গরম গরম দিই। ক্ষেন্তি, জল-দেওয়া ভাত আছে ও-বেলার, বার করে নিয়ে আয়।
ক্ষেন্তির নিকট অন্নপূর্ণার এ প্রস্তাব যে মনঃপূত হইল না, তাহা তার মুখ দেখিয়া বোঝা গেল। পুঁটি বলিল—মা, বড়দি পিঠেই খাক। ভালোবাসে। ভাত বরং থাকুক, আমরা কাল সকালে খাব।
খানকয়েক খাইবার পরেই মেজো মেয়ে পুঁটি খাইতে চাহিল না। সে নাকি অধিক মিষ্টি খাইতে পারে না। সকলের খাওয়া শেষ হইয়া গেলেও ক্ষেন্তি তখনও খাইতেছে। সে মুখ বুজিয়া শান্তভাবে খায়, বড় একটা কথা কহে না। অন্নপূর্ণা দেখিলেন, সে কম করিয়াও আঠারো-উনিশখানা খাইয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলেন—ক্ষেন্তি, আর নিবি? ক্ষেন্তি খাইতে খাইতে শান্তভাবে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িল। অন্নপূর্ণা তাহাকে আরও খানকয়েক দিলেন। ক্ষেন্তির মুখ চোখ ঈষৎ উজ্জ্বল দেখাইল, হাসিভরা চোখে মা’র দিকে চাহিয়া বলিল—বেশ খেতে হয়েছে মা ঐ যে তুমি কেমন ফেনিয়ে নাও, ওতেই কিন্তু… সে পুনরায় খাইতে লাগিল।
অন্নপূর্ণা হাতা, খুন্তী, চুলী তুলিতে তুলিতে সস্নেহে তাঁর এই শান্ত নিরীহ একটু অধিক মাত্রায় ভোজনপটু মেয়েটির দিকে চাহিয়া রহিলেন। মনে মনে ভাবিলেন—ক্ষেন্তি আমার যার ঘরে যাবে, তাদের অনেক সুখ দেবো এমন ভালোমানুষ, কাজ কর্মে বকো, মারো, গাল দাও, টু শব্দটি মুখে নেই। উঁচু কথা কখনো কেউ শোনেনি…
বৈশাখ মাসের প্রথমে সহায়হরির এক দূর-সম্পৰ্কীয় আত্মীয়ের ঘটকালিতে ক্ষেন্তির বিবাহ হইয়া গেল। দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ করিলেও পাত্রটির বয়স চল্লিশের খুব বেশি কোনোমতেই হইবে না। তবুও প্রথমে এখানে অন্নপূর্ণা আদৌ ইচ্ছুক ছিলেন না, কিন্তু পাত্রটি সঙ্গতিপন্ন, শহর অঞ্চলে বাড়ী, সিলেট চুন ও ইটের ব্যবসায়ে দু’পয়সা নাকি করিয়াছে—এরকম পাত্র হঠাৎ মেলাও বড় দুর্ঘট কিনা!
জামাইয়ের বয়স একটু বেশি, প্রথমে অন্নপূর্ণা জামাইয়ের সম্মুখে বাহির হইতে একটু সঙ্কোচ বোধ করিতেছিলেন, পরে পাছে ক্ষেন্তির মনে কষ্ট হয় এই জন্য বরণের সময় তিনি ক্ষেন্তির সুপুষ্ট হস্তখানি ধরিয়া জামাইয়ের হাতে তুলিয়া দিলেন—চোখের জলে তাঁহার গলা বন্ধ হইয়া আসিল, কিছু বলিতে পারিলেন না।
বাড়ীর বাহির হইয়া আমলকীতলায় বেহারারা সুবিধা করিয়া লইবার জন্য বরের পাল্কী একবার নামাইল। অন্নপূর্ণা চাহিয়া দেখিলেন, বেড়ার ধারের নীল রং-এর মেদিফুলের গুচ্ছগুলি যেখানে নত হইয়া আছে, ক্ষেন্তির কম দামের বালুচরের রাঙা চেলীর আঁচলখানা পাল্কীর বাহির হইয়া সেখানে লুটাইতেছে। …তাঁর এই অত্যন্ত অগোছালো, নিতান্ত নিরীহ এবং একটু অধিক মাত্রায় ভোজনপটু মেয়েটিকে পরের ঘরে অপরিচিত মহলে পাঠাইতে তাঁর বুক উদ্বেল হইয়া উঠিতেছিল। ক্ষেন্তিকে কি অপরে ঠিক বুঝিবে?…
যাইবার সময়ে ক্ষেন্তি চোখের জলে ভাসিতে ভাসিতে সান্ত্বনার সুরে বলিয়াছিল—মা, আষাঢ় মাসেই আমাকে এনো…বাবাকে পাঠিয়ে দিও…দু’টো মাস তো…
ও-পাড়ার ঠানদিদি বলিলেন—তোর বাবা তোর বাড়ী যাবে কেন রে, আগেনাতি হোক—তবে তো…
ক্ষেন্তির মুখ লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিল। জলভরা ডাগর চোখের উপর একটুখানি লাজুক হাসির আভা মাখাইয়া সে একগুয়েমি সুরে বলিলনা, যাবে না বৈ কি!…দেখো তো কেমন না যান…
ফাল্গুন-চৈত্র মাসের বৈকালবেলা উঠানের মাচায় রৌদ্রে দেওয়া আমসত্ব তুলিতে তুলিতে অন্নপূর্ণার মন হু-হু করিত…তাঁর অনাচারী ললাভী মেয়েটি আজ বাড়ীতে নাই যে, কোথা হইতে বেড়াইয়া আসিয়া লজ্জাহীনার মতন হাতখানি পাতিয়া মিনতির সুরে অমনি বলিবে—মা, বলব একটা কথা? ঐ কোণটা ছিঁড়ে একটুখানি…
এক বছরের উপর হইয়া গিয়াছে। পুনরায় আষাঢ় মাস বর্ষা বেশ নামিয়াছে। ঘরের দাওয়ায় বসিয়া সহায়হরি প্রতিবেশী বিষ্ণু সরকারের সহিত কথা বলিতেছেনা সহায়হরি তামাক সাজিতে সাজিতে বলিলেন—ও তুমি ধরে রাখ, ও রকম হবেই দাদা আমাদের অবস্থার লোকের ওর চেয়ে ভাল কি আর জুটবে?
বিষ্ণু সরকার তালপাতার চাটাইয়ের উপর উবু হইয়া বসিয়াছিলেন, দূর হইতে দেখিলে মনে হইবার কথা, তিনি রুটি করিবার জন্য ময়দা চটকাইতেছেন। গলা পরিষ্কার করিয়া বলিলেন— নাঃ, সব তো আর…তা ছাড়া আমি যা দেব নগদই দেব। …তোমার মেয়েটির হয়েছিল কি?
সহায়হরি হুকাটায় পাঁচ-ছ’টি টান দিয়া কাসিতে কাসিতে বলিলেন—বসন্ত হয়েছিল শুনলাম। ব্যাপার কি দাঁড়াল, বুঝলে? মেয়ে তো কিছুতে পাঠাতে চায় না। আড়াইশো আন্দাজ টাকা বাকি ছিল, বললে, ও টাকা আগে দাও, তবে মেয়ে নিয়ে যাও।
—একেবারে চামার…
—তারপর বললাম, টাকাটা ভায়া ক্রমে ক্রমে দিচ্ছি। পুজোর তত্ব কম করেও ত্রিশটে টাকার কমে হবে না ভেবে দেখলাম কিনা? মেয়ের নানা নিন্দে ওঠালে…ছোটলোকের মেয়ের মতন চলে, হাভাতে ঘরের মত খায়…আরও কত কি। পৌষ মাসে দেখতে গেলাম, মেয়েটাকে ফেলে থাকতে পারতাম না, বুঝলে…
সহায়হরি হঠাৎ কথা বন্ধ করিয়া জোরে মিনিট কতক ধরিয়া হুঁকায় টান দিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ দু’জনের কোনো কথা শুনা গেল না।
অল্পক্ষণ পরে বিষ্ণু সরকার বলিলেন—তারপর?
—আমার স্ত্রী অত্যন্ত কান্নাকাটি করতে পৌষ মাসে দেখতে গেলাম মেয়েটার যে অবস্থা করেছে! শাশুড়ীটা শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল, না জেনেশুনে ছোটলোকের সঙ্গে কুটুম্বিতে করলেই এরকম হয়, যেমনি মেয়ে তেমনি বাপ, পৌষ মাসের দিনে মেয়ে দেখতে এলেন শুধু হাতে! পরে বিষ্ণু সরকারের দিকে চাহিয়া বলিলেন—বলি আমরা ছোটলোক কি বড়লোক তোমার তো সরকার খুড়ো জানতে বাকি নেই, বলি পরমেশ্বর চাটুয্যের নামে নীলকুচির আমলে এ অঞ্চলে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেয়েছে—আজই না হয় আমি প্রাচীন… আভিজাত্যের গৌরবে সহায়হরি শুদ্ধস্বরে হা হা করিয়া খানিকটা শুষ্ক হাস্য করিলেন।
বিষ্ণু সরকার সমর্থনসূচক একটা অস্পষ্ট শব্দ করিয়া বারকতক ঘাড় নাড়িলেন।
—তারপর ফাল্গুন মাসেই তার বসন্ত হলো। এমন চামার—বসন্ত গায়ে বেরুতেই টালায় আমার এক দূর-সম্পর্কের বোন আছে, একবার কালীঘাটে পুজো দিতে এসে তার খোঁজ পেয়েছিল—তারই ওখানে ফেলে রেখে গেল। আমায় না একটা সংবাদ, না কিছু তারা আমায়। সংবাদ দেয়। তা আমি গিয়ে…
—দেখতে পাওনি?
নাঃ! এমনি চামার—গহনাগুলো অসুখ অবস্থাতেই গা থেকে খুলে নিয়ে তবে টালায় পাঠিয়ে দিয়েছে। …যাক, তা চল যাওয়া যাক, বেলা গেল। …চার কি ঠিক করলে?…পিঁপড়ের টোপে মুড়ির চার তো সুবিধে হবে না। …
তারপর কয়েক মাস কাটিয়া গিয়াছে। আজ আবার পৌষ-পার্বণের দিন। এবার পৌষ মাসের শেষাশেষি এত শীত পড়িয়াছে যে, এরূপ শীত তাঁহারা কখনও জ্ঞানে দেখেন নাই।
সন্ধ্যার সময় রান্নাঘরের মধ্যে বসিয়া অন্নপূর্ণা সরুচাকলি পিঠের জন্য চালের গুঁড়ার গোলা তৈয়ারী করিতেছেন। পুঁটি ও রাধী উনুনের পাশে বসিয়া আগুন পোহাইতেছে।
রাধী বলিতেছে—আর একটু জল দিতে হবে মা, অত ঘন করে ফেললে কেন?
পুঁটি বলিল—আচ্ছা মা, ওতে একটু নুন দিলে হয় না?
—ওমা দেখ মা, রাধীর দোলাই কোথায় ঝুলছে এক্ষুনি ধরে উঠবে…
অন্নপূর্ণা বলিয়া উঠিলেন—সরে এসে বোসো মা, আগুনের ঘাড়ে গিয়ে না বসলে কি আগুন পোহানো হয় না? এই দিকে আয়
গোলা তৈয়ারী হইয়া গেলে…খোলা আগুনে চড়াইয়া অন্নপূর্ণা গোলা ঢালিয়া মুচি দিয়া চাপিয়া ধরিলেন…দেখিতে দেখিতে মিঠে আঁচে পিঠে টোপরের মতন ফুলিয়া উঠিল।…
পুঁটি বলিল—মা, দাও, প্রথম পিঠেখানা কানাচে ষাঁড়া ষষ্ঠীকে ফেলে দিয়ে আসি।
অন্নপূর্ণা বলিলেন—একা যাস নে, রাধীকে নিয়ে যা
খুব জ্যোৎস্না উঠিয়াছিল, বাড়ীর পিছনে ষাঁড়াগাছের ঝোপের মাথায় তেলাকুচা লতার থোলো। যোলো সাদা ফুলের মধ্যে জ্যোৎস্না আটকিয়া রহিয়াছে। …
পুঁটি ও রাধী খিড়কী দোর খুলিতেই একটা শিয়াল শুকনো পাতায় খস খস করিতে করিতে ঘন ঝোপের মধ্যে ছুটিয়া পলাইলা পুঁটি পিঠেখানা জোর করিয়া হুঁড়িয়া ঝোপের মাথায় ফেলিয়া দিল। তাহার পর চারিধারের নির্জন বাঁশবনের নিস্তব্ধতায় ভয় পাইয়া ছেলেমানুষ পিছু হটিয়া আসিয়া খিড়কী-দরজার মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়া তাড়াতাড়ি দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। …
পুঁটি ও রাধী ফিরিয়া আসিলে অন্নপূর্ণা জিজ্ঞাসা করিলেন—দিলি?
পুঁটি বলিল—হ্যাঁ মা, তুমি আর বছর যেখান থেকে নেবুর চারা তুলে এনেছিলে সেখানে ফেলে দিলাম…
তারপর সে রাত্রে অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। পিঠে গড়া প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে…রাতও তখন খুব বেশি …জ্যোৎস্নার আলোয় বাড়ীর পিছনের বনে অনেকক্ষণ ধরিয়া একটা কাঠঠোকরা পাখী ঠক-র-র-র শব্দ করিতেছিল, তাহার স্বরটাও যেন ক্রমে তন্দ্রালু হইয়া পড়িতেছে…দুই বোনের খাইবার জন্য কলার পাতা চিরিতে চিরিতে পুঁটি অন্যমনস্ক ভাবে হঠাৎ বলিয়া উঠিল— দিদি বড় ভালবাসত…
তিনজনেই খানিকক্ষণ নির্বাক হইয়া বসিয়া রহিল, তাহার পর তাহাদের তিনজনেরই দৃষ্টি কেমন করিয়া আপনা-আপনি উঠানের এক কোণে আবদ্ধ হইয়া পড়িল…সেখানে বাড়ীর সেই লোভী মেয়েটির ললাভের স্মৃতি পাতায়-পাতায় শিরায়-শিরায় জড়াইয়া তাহার কত সাধের নিজের হাতে পোঁতা পুঁইগাছটি মাচা জুড়িয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে…বর্ষার জল ও কার্তিক মাসের শিশির লইয়া কচি-কচি সবুজ ডগাগুলি মাচাতে সব ধরে নাই, মাচা হইতে বাহির হইয়া দুলিতেছে…সুপুষ্ট, নধর, প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর।
পুঁইমাচা গল্পের উৎস, প্রকাশকাল, সারাংশ ও নামকরণের সার্থকতা
উৎস
মেঘমল্লার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম গল্পগ্রন্থ। বইটি ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইতে সংকলিত ছোটোগল্পগুলি হল ‘মেঘমল্লার’, ‘উমারাণী’, ‘বউ-চণ্ডীর মাঠ’, ‘নব-বৃন্দাবন’, ‘অভিশপ্ত’, ‘খুকীর কাণ্ড’, ‘ঠেলাগাড়ী’, ‘পুঁইমাচা’ ও ‘উপেক্ষিতা’। গল্পগুলি ১৯২১ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে রচিত। তিনটি গল্প বিচিত্রা ও বাকি সাতটি গল্প প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এই গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘মেঘমল্লার’ বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ গল্প। তাই ‘মেঘমল্লার’ হল পুঁইমাচা গল্পের উৎস।
প্রকাশকাল
পুঁইমাচা গল্পটি ১৯৩১ সালে প্রথম প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
সারাংশ ও নামকরণের সার্থকতা
কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতিপ্রেমিক ও নির্জন প্রান্তবাসী, এ কথা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে। প্রকৃতির সহিত মানব মনের যে একটি অন্তর্গুঢ় সম্পর্ক আছে, বিভূতিভূষণের সকল রচনায় তা বিশেষভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রকৃতির স্নেহ ছায়ায় মানুষ সব-দুঃখ, সব-বেদনা ভুলে অপার আনন্দ লাভ করতে পারে, এই ছিল বিভূতিভূষণের জীবন বেদ। সেই হেতু তাঁর সকল রচনায় প্রকৃতিপ্রেমচেতনা মুখ্য হয়ে উঠেছে — প্রকৃতির মধ্যে মানুষ তার জীবনের সত্যবোধ খুজে পেয়েছে। প্রকৃতির মনোরম পরিবেশ থেকে ছিন্ন হয়ে একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের কন্যা ক্ষেন্তি কিভাবে অকাল মৃত্যুবরণ করল, তারই মর্মন্তুদ কাহিনী ‘পুঁইমাচা’ গল্পে পরিবেশিত হয়েছে। ছোট সুখ, ছোট আশা নিয়ে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে কিভাবে অভিন্ন হয়ে প্রতীকী রূপ লাভ করে, ‘পুঁইমাচা’ গল্পে তা সবিশেষ পরিলক্ষিত হয়।
‘পুঁইমাচা’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। গল্পটি গ্রাম বাংলার একটি দরিদ্র পরিবারকে কেন্দ্র করে দানা বেঁধে উঠেছে। গল্পটি সংক্ষেপে এইরূপ:
অন্নপূর্ণা-সহায়হরির তিন কন্যা ক্ষেন্তি, পুঁটি ও রাধি। ক্ষেন্তি নিম্নবিত্ত বাঙালি বাড়ির মেয়ে। তার বিয়ের বয়স হয়েছে—বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে কিন্তু পাত্রের চরিত্র খুবই নিন্দনীয় জেনে বাবা সহায়হরি এ বিয়ে ভেঙে দেন। পল্লীর অন্যতম মাতব্বর কালীময় ঠাকুর সহায়হরিকে এক ঘরে করার পরিকল্পনা করেন। ক্ষেন্তি পুইচ চচ্চড়ি খেতে ভালোবাসে—-বাড়ির সবাই সেকথা জানে। কিন্তু ক্ষেন্তির হাতে পাকা পুঁইশাক দেখে মা অন্নপূর্ণা মেয়ের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মায়ের কঠিন কথায় ক্ষেন্তির হাত থেকে পাকা পুঁইডাঁটা গুলো পড়ে যায়। অথচ পুঁইশাকের প্রতি বড়মেয়ে ক্ষেন্তির দুর্বলতার কথা সকলের থেকে বেশি জানে মা অন্নপূর্ণা। তাই মা অন্নপূর্ণা পুঁইডাঁটার চচ্চড়ি রেঁধে দুপুরে ভাতের সঙ্গে খেতে দিয়ে ক্ষেন্তিকে অবাক করে দেন। আর ক্ষেন্তি অপার আনন্দে অথচ ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পাতের চচ্চড়ি একেবারে নিঃশেষ করে ফেলে।
এই গল্পে আমরা দেখি, শান্ত, নম্র হলেও ক্ষেন্তি কিন্তু ভোজনপ্রিয় ছিল। ভালো-মন্দ সবরকম খাদ্যের প্রতি ছিল তার অফুরন্ত লোভ। তাই, সবদিক ভেবেচিন্তে বড় মেয়ে ক্ষেন্তি স্থির করল যে, সে তরকারির বাগান বানাবে—চুরির অপরাধ সে নেবে না। ছোট বোনকে নিয়ে ভাঙ্গা পাঁচিলের ধারে জমিটায় গজিয়ে ওঠা জঙ্গল পরিষ্কার করে সে তরকারির বাগান তৈরি করার ব্যবস্থা করে। মা অন্নপূর্ণাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে সে বাগান দেখায়। মাও খুব খুশি হয়। গোবর কুড়িয়ে এনে ক্ষেন্তি সারের প্রয়োজন মেটায়।
কিন্তু তরকারি বলতে তখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল একটি শীর্ণকায় পুঁইগাছ—একই রকম চেহারার একটি কঞ্চির সঙ্গে জড়িয়ে দিয়ে ফাঁসির মতো করে বাঁধা। ঠিক এমন সময় ক্ষেন্তির বিয়ে হল কোলকাতার বাসিন্দা স্বচ্ছল-পরিবারের দোজবরের সঙ্গে, যার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। বৈশাখে বিয়ে—আষাঢ়েই ক্ষেন্তির বাপের বাড়ি আসার ইচ্ছা ছিল—কিন্তু সেই ইচ্ছা আর পূর্ণ হলো না। বিয়ের পনের টাকা বাকি ছিল বলে মেয়েকে আনতে গিয়েও আনতে পারল না সহায়হরি। বিয়ের পনের টাকা না দেওয়ার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে ক্ষেন্তিকে। অনেক অত্যাচার, অনেক অবহেলা পেয়ে হঠাৎ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষেন্তি মারা গেল।
কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই গল্পে নিম্নবিত্ত বাঙালির যে করুন জীবনচিত্র আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন, তা সত্যিই করুনা মণ্ডিত। সমাজে অবজ্ঞাত-অবহেলিত-অত্যাচারিত সহায়সম্বলহীন মানুষের জীবনচিত্র লেখক বিভূতিভূষণ অতি সুন্দরভাবে অঙ্কন করেছেন। এই গল্পে ক্ষেন্তি যেন পুঁইমাচারই প্রতীক হয়ে উঠেছে। পুঁইমাচা এবং ক্ষেন্তি এক ও অভিন্ন। কেননা, এই ক্ষেন্তি জীবনের সবটুকু না পেয়ে অকালে ঝরে গিয়েছে। প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে পরিপুষ্টি ক্ষেন্তি শহুরে আদব-কায়দা পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পারল না। ফলে ক্ষেন্তির মনের আশা মেটে না-মনেই থেকে যায়।
এই গল্পে আমরা দেখি সেই ভোজন বিলাসী লোভী মেয়ে ক্ষেন্তি বাড়িতে নেই। কিন্তু তার কথা সকলেরই মনে পড়ে অহরহ—অথচ তার কথা কেউ উত্থাপন করে না, একবারও মুখে আনে না। হৃদয়ের মধ্যেই সকলে ক্ষান্তিকে গভীরভাবে স্থান দিয়েছে—-আর বাইরে তার কথা যেন শূন্যতায় পরিণত হয়েছে।
পৌষ সংক্রান্তি ঘুরে এল। পনের বছরের সেই মেয়েটি অর্থাৎ ক্ষেন্তি মা অন্নপূর্ণার তৈরি পিঠের জন্য বসে নেই। হঠাৎ পুঁটি বলে বসল, —-
‘দিদি বড় ভালোবাসতো…..।’
পুঁটির মুখ দিয়ে কথাটি বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন জন যেন অসাড় হয়ে গেল। কোন এক ফেলে আসা স্মৃতি জেগে উঠলো সকলের মনে। অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে রইল সবাই। যার কথাটি হঠাৎ উঠে পড়েছে, সে যেন এখনো বেঁচে আছে ওই ভাঙা প্রাচীরের ধারে। মুখে কিছু না বললেও নিশ্চয়ই গোপনে প্রতিদিন সেদিকে সকলে চেয়ে দেখে। ক্ষেন্তির স্মৃতি মনের মধ্যে জেগে ওঠায় সেই মুহূর্তে ক্ষেন্তির স্মৃতি ঘেরা স্থানটির দিকে তিনজনের দৃষ্টি একসঙ্গে আবদ্ধ হলো। সবাই দেখলো, —-
‘সেখানে বাড়ির সেই লোভী মেয়েটির লোভের স্মৃতি পাতায় পাতায় শিরায় শিরায় জড়াইয়া তাহার কত সাধের নিজের হাতে পোঁতা পুঁই গাছটি মাচা জুড়িয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে …. বর্ষার জল ও কার্তিক মাসের শিশির লইয়া কচি কচি সবুজ পাতা গুলি মাচাতে সব ধরে নাই, মাচা হইতে বাহির হইয়া দুলিতেছে …. সুপুষ্ট, নধর, প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর।’
যে লোভী মেয়েটি বাড়ির সকলের হৃদয় জুড়ে ছিল, যার কথা বাইরে প্রকাশ করতে পারছিল না কেউ, অথচ এড়াবার কোন উপায় নেই—ভাঙ্গা প্রাচীরের ধারে সমস্ত মাচাটি জুড়ে তারই অধিষ্ঠান।
পুঁই গাছ সমস্ত মাচা জুড়ে রয়েছে—যেন ঐ মেয়েটির মতো (ক্ষেন্তি) ডাগর-ডাগর শান্ত ভয় চকিত দৃষ্টি মেলে সকলের হৃদয় জুড়ে আছে। কচি ডগা গুলো মাটি ছাড়িয়ে দুলছে। হৃদয় ছাপিয়ে সরুচাকলির মধ্যে, বিশেষ করে প্রাচীরের ওই পুঁইমাচায় তারই তো (ক্ষেন্তি) হাতছানি দেখা যায়। পুঁই চচ্চড়ির প্রতি মেয়েটির যে লোভ, তারই বহি:প্রকাশ ঐ পুঁইমাচা। ক্ষেন্তি এবং পুঁইমাচা এই গল্পে এক ও ভিন্ন হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণের অসাধারণ রচনা দক্ষতায় এই পুঁইমাচাটি ‘প্রধান চরিত্র’ হয়ে উঠেছে। তাই এই গল্পটির নামকরণ হয়েছে ‘পুঁইমাচা’। এবং আমরা মনে করি এ গল্পের নামকরণ ‘পুঁইমাচা’ সার্থক ও সুসংগত।
পরিশেষে বলা যায় যে, প্রকৃতিপ্রেমিক বিভূতিভূষণ এই গল্পে প্রকৃতির সহিত মানুষকে অভিন্ন হৃদয় করে দিতে পেরেছেন। তিনি মনে করেন, মানুষ পরম শান্তি পেতে পারে একমাত্র প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতি বিভূতিভূষণের কাছে স্নেহময়ী, মমতাময়ী জননী। কেবল প্রকৃতি মানুষের সব-দুঃখ, সব-বেদনা নিমিষে মুছে দিতে পারে। এই প্রকৃতির সহিত ক্ষেতির মিল খুঁজে পেয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি অনুভব করেছেন—-Innocence এর মূল্য দেওয়ার মতো মানুষ সংসারে খুব বেশি নেই। তাই এই গল্পে ক্ষেন্তিকে বৈষয়িক জগৎ থেকে অকালে চলে যেতে হল। কিন্তু লেখক বিভূতিভূষণ এই গল্পে দেখিয়েছেন, ক্ষেন্তির জীবনের ছোট আশা–আকাঙ্ক্ষার স্বাক্ষর সে রেখে গিয়েছে তারই রোপিত পুঁইমাচায়। তাই গল্পটির নামকরণ ‘পুঁইমাচা’ সুসংহত ও সার্থকতামণ্ডিত। এবং সেইসঙ্গে প্রকৃতিপ্রেমিক বিভূতিভূষণের প্রকৃতিপ্রেম চেতনার স্বরূপটিও এই গল্পে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
পুঁইমাচা গল্পের অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর
১) পুঁইমাচা গল্পের লেখক হলেন- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
২) পুঁইমাচা গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল- প্রবাসী পত্রিকায়
৩) পুঁইমাচা গল্পের প্রধান চরিত্র- ক্ষেন্তি
৪) ক্ষেন্তির পিতার নাম হলো- সহায়হরি
৫) ক্ষেন্তির মায়ের নাম হলো- অন্নপূর্ণা
৬) সহায়হরির মেয়ে ছিল- তিনজন
৭) সহায়হরির তিন মেয়ের নাম হল- ক্ষেন্তি, পুঁটি ও রাধী
৮) ক্ষেন্তির বিবাহ স্থির হয়েছিল যার সাথে- শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলে
৯) শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলে ছিল- অসৎ চরিত্রের
১০) শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলেকে প্রহার করেছিল- কুম্ভকার বধূর আত্মীয়রা
১১) শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলের সাথে ক্ষেন্তির বিয়ে- সহায়হরি ভেঙে দেন
১২) সহায়হরি ও ক্ষেন্তি জঙ্গলে গিয়েছিল- মেটে আলু তুলতে
১৩) ‘তিনকাল গিয়েছে এক কাল আছে’ বলেছিল- অন্নপূর্ণা
১৪) ‘তিনকাল গিয়েছে এক কাল আছে’ বলা হয়েছিল- সহায়হরিকে
১৫) সহায়হরি মেটে আলু এনেছিল- বরোজ পোতার বন থেকে
১৬) সহায়হরি বলেছিল সে মেটে আলু এনেছে- চৌকিদারের বেড়ার গা থেকে
১৭) অন্নপূর্ণা মেয়েদের জন্য পিঠা বানিয়েছিল- পৌষ সংক্রান্তিতে
১৮) অন্নপূর্ণা পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠা বানিয়েছিল- তিন মেয়ের জন্য
১৯) অন্নপূর্ণা পৌষ সংক্রান্তিতে যে পিঠা বানিয়েছিল- পাটি সাপটা
২০) অন্নপূর্ণা পৌষ সংক্রান্তিতে পাটি সাপটা বানিয়েছিল- নারিকেলের পুর দিয়ে
২১) ক্ষেন্তি পাটি সাপটা খেয়েছিল- বাইশ-চব্বিশটা
২২) ক্ষেন্তির বিয়ে হয়েছিল- বৈশাখ মাসে
২৩) ক্ষেন্তির জন্য যে পাত্র দেখা হয়েছিল তার বয়স ছিল- চল্লিশের বেশি নয়
২৪) ক্ষেন্তির জন্য যে পাত্র দেখা হয়েছিল তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল- সঙ্গতি সম্পন্ন
২৫) ক্ষেন্তির জন্য যে পাত্র দেখা হয়েছিল তার বাড়ি ছিল- শহরে
২৬) ক্ষেন্তির জন্য যে পাত্র দেখা হয়েছিল শোনা গিয়েছিল তার ছিল- ব্যবসা
২৭) ক্ষেন্তি বিদায়কালে তার মাকে যে মাসে নিয়ে আসতে বলেছিল- আষাঢ়
২৮) ক্ষেন্তি বাড়িতে নিয়ে আসার কথা বলেছিল- দুই মাস বাদে
২৯) ক্ষেন্তির শশুড় বাড়ির মতে ক্ষেন্তির খাওয়া ছিল- হাভাতের মতো
৩০) ক্ষেন্তির শশুড় বাড়ির মতে ক্ষেন্তির চাল-চলন ছিল- ছোটলোকের মেয়ের মতো
৩১) বিয়ের যত মাসের মাথায় ক্ষেন্তি মারা যায়- দশ মাস
৩২) ক্ষেন্তির বিয়ে হয়েছিল- বৈশাখ মাসে
৩৩) বিয়ের সময় ক্ষেন্তির বয়স ছিল- পনেরো বছর
৩৪) ক্ষেন্তির বিবাহ স্থির হওয়া পাত্রের বয়স ছিল- চল্লিশ বছর
৩৫) পাত্রটি ছিল- দ্বিতীয় পক্ষের
৩৬) ক্ষেন্তি মারা গিয়েছিল- ফাল্গুন মাসে
৩৭) ক্ষেন্তির যে রোগ হয়েছিল- বসন্ত
৩৮) ক্ষেন্তিকে তার শশুর বাড়ির লোকেরা রেখে এসেছিল- টালায়
৩৯) ক্ষেন্তিকে তার শশুর বাড়ির লোকেরা কালীঘাটে রেখে এসেছিল- সহায়হরির দূর সম্পর্কের এক বোনের বাড়িতে
৪০) ক্ষেন্তি মারা গিয়েছিল- বিনা চিকিৎসায়
৪১) ক্ষেন্তি ভালোবাসতো- খেতে
৪২) ক্ষেন্তিকে গল্পে বিশেষায়িত করা হয়েছে যা বলে- লোভী মেয়েটি
৪৩) ক্ষেন্তি যে গাছের চারা লাগিয়েছিল- পুঁই
৪৪) যে গাছ দেখে অন্নপূর্ণা ও তার দুই মেয়ের ক্ষেন্তির কথা মনে পড়েছে- পুঁই
৪৫) ক্ষেন্তির করুণ পরিণতির জন্য দায়ী- সমাজ ব্যবস্থা
৪৬) ‘পুঁইমাচা’ গল্পের উৎস- মেঘমল্লার
৪৭) গাছ কেটেছিল- তারক খুড়ো
৪৮) অন্নপূর্ণা যে তেল চুলে মাখছিলেন- নারকেল
৪৯) গায়ে রটে যাওয়া গুজব সম্পর্কে জানা যেত- চৌধুরী বাড়িতে
৫০) স্ত্রীর মতানুসারে সহায়হরি ঘুরে বেরান- বাগদী দুলে পাড়ায়
৫১) পিনটির বয়স খুঁজলে যে যুগের বলে জানা যায়- প্রাগৈতিহাসিক
৫২) ক্ষেন্তি চিংড়ি মাছে এনেছিল যার থেকে- গয়া পিসি
৫৩) পুঁই শাকগুলি দিয়েছেন- রায় কাকা
৫৪) গয়া পিসির কাছে সহায়হরির ধার ছিল- দুটি পয়সা
৫৫) মায়ের মতে ক্ষেন্তির বিয়ে হলে সে যত সন্তানের মা হতো- চার
৫৬) অন্নপূর্ণা পুঁইশাক ফেলে দিয়ে আসতে বলেছিলেন- রাধীকে
৫৭) রাধী ছিল- ছোট মেয়ে
৫৮) অন্নপূর্ণা চোখের জল চাপতে যা করেছিলেন- চালের বাতায় গোঁজা ডালা থেকে শুকনো লঙ্কা পাড়ছিলেন
৫৯) চন্ডীমন্ডপে সহায়হরিকে ডাকা হয়েছিল- বিকেল বেলা
৬০) পচা-র জাতি হল- শ্রোত্রিয়
৬১) আশীর্বাদের যত দিনের মাথায় সহায়হরি পাত্রের চরিত্র সম্পর্কে জানতে পারেন- দিন কতক পরে
৬২) সকালের রোদখানি ছিল- কচি, রাঙা
৬৩) বাপ মেয়ের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল তারা- সিঁধ দেবার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে
৬৪) অন্নপূর্ণা মুখুয্যে বাড়ি যাওয়ার পথে যা পাখি দেখেন- লেজঝোলা হলদে পাখি লে
৬৫) লেজঝোলা হলদে পাখি যে গাছের ডালে বসেছিল- আমড়া
৬৬) সহায়হরির আনা মেটে আলুর ওজন- পনেরো-ষোলো সের
৬৭) সহায়হরি মেটে আলু এনেছিল- বরজপোতার বন থেকে
৬৮) ক্ষেন্তির স্নান সেরে আসতে সময় লেগেছিল- আধ ঘন্টা
৬৯) ক্ষেন্তির উত্তর শুনে অন্নপূর্ণা রেগে উঠেছিলেন- তেলে বেগুনে
৭০) বরজপোতার বিজন বনে দিনে দুপুরে লুকিয়ে থাকে- বাঘ
৭১) ভাঙ্গা পাঁচিলের ধারের ছোট খোলা জমির জঙ্গলে যে গাছ ছিল- পাথরকুচি-কোন্টিকারী
৭২) ভাঙ্গা পাঁচিলের ধারের ছোট খোলা জমির জঙ্গল যারা পরিষ্কার করছিল- ক্ষেন্তি ও তার ছোটবোন
৭৩) অন্নপূর্ণার মতে পুঁইচারা পোঁতার সময়- বর্ষাকাল
৭৪) ক্ষেন্তি পুঁই গাছকে বাঁচাবে- রোজ জল ঢেলে
৭৫) অন্নপূর্ণার যে কারণে মনে হয়েছে পুই ডাঁটাটি হয়তো বেঁচে যাবে- রাতে খুব শিশির পড়ে
৭৬) সহায়হরি সকালে ছোট মেয়েকে গায়ে যা দিতে দেখলেন- দোলাই
৭৭) সহায়হরির ছোট মেয়ে শীত সকালে যার প্রত্যাশায় ছিল- রোদ উঠবার
৭৮) রোদ উঠবার আশায় দুই বোন যে গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল- কাঁঠাল তলায়
৭৯) ক্ষেন্তি শীত সকালে গিয়েছিল- গোবর কুড়াতে
৮০) ক্ষেন্তি গোবর কুড়াতে যেখানে গিয়েছিল- মুখুয্যে বাড়িতে
৮১) গোবর কুড়িয়ে আনার জন্য ক্ষেন্তি যা ব্যবহার করেছিল- ভাঙা ঝুড়ি
৮২) সহায়হরি মেয়ের মুখ অনেকদিন পরে ভাল করে দেখলেন- সুশ্রী হয়েছে
৮৩) ক্ষেন্তির জামাখানি আনা হয়েছিল- হরিপুরের রাসের মেলা থেকে
৮৪) ক্ষেন্তির জামাখানি হরিপুরের রাসের মেলা থেকে এনেছিল- সহায়হরি
৮৫) হরিপুরের মেলা থেকে আনা ক্ষেন্তির জামার মূল্য ছিল- আড়াই টাকা
৮৬) বর্তমানে জামাখানি যে কারনে অব্যবহার্য হয়ে পড়েছে- ছোট হয়ে যাওয়ায়
৮৭) জামা খানির রঙ ছিল- কালো
৮৮) জামাখানির বর্তমান অবস্থান- টিনের তোরঙ্গে
৮৯) জামাখানি ছিল- সার্জের
৯০) অন্নপূর্ণা পিঠে বানাচ্ছিলেন- পৌষ সংক্রান্তিতে
৯১) পিঠে বানাতে ব্যবহৃত দ্রব্যগুলি হল- চালের গুঁড়া, ময়দা, গুড় ও নারকেলকোরা
৯২) অন্নপূর্ণা প্রথমে ক্ষেন্তিকে নারকেল কুরতে দেন নি, কারণ- কাপড় চোপড় শুচি নয় বলে
৯৩) ক্ষেন্তি ময়দার গোলা চায়নি, কারণ- মা পাছে বকে
৯৪) অন্নপূর্ণা ক্ষেন্তির জন্য ময়দার মাখা গোলা রেখেছিলেন- নারিকেলের মালাতে
৯৫) পৌষ সংক্রান্তিতে ক্ষীর তৈরি করেছিল- রাঙা দিদি
৯৬) পুঁটির জেঠাইমারা ওবেলা যাদের নেমন্তন্ন করেছিল- সুরেশ কাকা ও তিনুর বাবাকে
৯৭) ক্ষেন্তির জেঠিমার বাড়িতে যে যে পিঠে হচ্ছিল- পায়েস, ঝোলপুলি ও মুগতক্তি
৯৮) অন্নপূর্ণা যা দিয়ে খোলায় তেল মাখাচ্ছিলেন- বেগুনের বোঁটা দিয়ে
৯৯) পাটিসাপটা করতে ক্ষীরের পুর লাগে এ কথা বলেছিল- খেঁদী
১০০) ক্ষেন্তি খেঁদীর বাড়ি গিয়েছিল- জামাই দেখতে
১০১) পাটিসাপটা ক্ষীর দিলে ছাই হয় খেতে কথা বলার কারণ- সামর্থের অভাবে না কুলানোয় বোনেদের মন রাখতে
১০২) মুখ হল মনের- দর্পণ
১০৩) অন্নপূর্ণা যাকে জল দেওয়া ভাত আনতে বলেন- ক্ষেন্তিকে
১০৪) ক্ষেন্তির নিকট অন্নপূর্ণার প্রস্তাব মনঃপূত হয় নি, কারণ- সে পিঠে খেতে চেয়েছিল
১০৫) যে প্রস্তাব দেয় যে বড়দি পিঠেই খাক- পুঁটি
১০৬) জল দেওয়া ভাত থাকলে তা তারা খাবে- পরের দিন সকালে
১০৭) পুঁটি খান কয়েক পিঠে খাওয়ার পরে আর খেতে চায়নি, কারণ- অধিক মিষ্টি হওয়ায়
১০৮) ক্ষেন্তি যতখানি পিঠে খাওয়ার পরও আরও পিঠে খেতে চেয়েছিল- আঠারো-উনিশ
১০৯) অন্নপূর্ণার মতে তার মেয়ে ক্ষেন্তি যার বাড়িতে যাবে তাদের সুখ দেবে কারণ, সে- কাজকর্মে বকুনি, মার খেলেও মুখে টুঁ শব্দ করে না
১১০) অন্নপূর্ণা খোলায় তেল মাখিয়েছিলেন যাতে করে- বেগুনের বোঁটায়
১১১) ক্ষীরের পুর দিয়ে ভাজলেই পিঠে হয় না, মনে করেছিল- ক্ষেন্তি
১১২) ক্ষেন্তির বিবাহ হয়েছিল- বৈশাখ মাসের প্রথমে
১১৩) পাত্রের বয়স ছিল- চল্লিশের খুব বেশি নয়
১১৪) বিয়েতে অন্নপূর্ণা ছিলেন- অনিচ্ছুক
১১৫) পাত্রের বাড়ি ছিল- শহরাঞ্চলে
১১৬) পাত্রের পরিবারের ব্যবসা ছিল- সিলেট চুন ও ইটের ব্যবসা
১১৭) পাত্রটির পরিবার ছিল- সংগতিপূর্ণ
১১৮) ক্ষেন্তির হাত জামাইয়ের হাতে দিয়েছিলেন- অন্নপূর্ণা
১১৯) বরের পালকী নামানো হয়েছিল, কারণ- বেহারার সুবিধা করে নেওয়ার জন্য
১২০) বরের পালকী নামানো হয়েছিল- আমলকীতলায়
১২১) বেড়ার ধারের মেদিফুলের গুচ্ছগুলি ছিল- নীল রং-এর
১২১) ক্ষেন্তি পড়েছিল- কম দামের বালুচরী শাড়ি
১২২) ক্ষেন্তি তাকে যে মাসে ফিরিয়ে আনতে বলেছিল- আষাঢ়
১২৩) আষাঢ় মাস হতে আর বাকি ছিল- দুই মাস
১২৪) নাতি দেখতে ক্ষেন্তির বাবা তার বাড়ি যাবে, বলেছিল- ঠানদিদি
১২৫) উঠানের মাচায় শুকোতে দেওয়া হতো- আমসত্ত্ব
১২৬) ‘ক্ষেন্তিকে কি অপরে ঠিক বুঝবে’ ভাবত- অন্নপূর্ণা
১২৭) অন্নপূর্ণার কাজ করতে করতে ক্ষেন্তির কথা মনে পড়েছিল- ফাল্গুন-চৈত্র মাসে
১২৮) ক্ষেন্তির কথা অন্নপূর্ণা মনে পড়েছিল- আমসত্ত্ব তুলতে তুলতে
১২৯) ‘তোমার মেয়েটির হয়েছিল কি?’- বক্তা হল- বিষ্ণু সরকার
১৩০) ক্ষেন্তি যে রোগে মারা গিয়েছিল- বসন্ত
১৩১) ‘একেবারে চামার’ চামার বলা হয়েছে- ক্ষেন্তির শশুরবাড়ির লোককে
১৩২) ক্ষেন্তির শ্বশুরবাড়ির কাছে সহায়হরির ধার ছিল- আড়াইশো টাকা
১৩৩) ক্ষেন্তির শ্বশুরবাড়ির জন্য পুজোর তত্ত্ব হবে- কম করে ত্রিশ টাকা
১৩৪) সহায়হরি মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল যে মাসে- পৌষ
১৩৫) ক্ষেন্তির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে রেখে এসেছিল- টালায়
১৩৬) ‘ছোট লোকের সঙ্গে কুটুম্বিতা করলেই এরকম হয়’ বলেছিল- ক্ষেন্তির শাশুড়ি
১৩৭) নীলকুঠির আমলে যার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেয়েছে- পরমেশ্বর চাটুজ্জে
১৩৮) ‘আগুনের ঘাড়ে না গিয়ে বসলে কি আগুন পোহানো হয় না?’ বলেছেন- অন্নপূর্ণা
১৩৮) ‘আগুনের ঘাড়ে না গিয়ে বসলে কি আগুন পোহানো হয় না?’- যাকে বলা হয়েছে- রাধীকে
১৩৯) ক্ষেন্তির বসন্ত হয়েছিল যে মাসে- ফাল্গুন
১৪০) ক্ষেন্তির মৃত্যুর পর পৌষ-পার্বণের দিনে অন্নপূর্ণা যে পিঠে বানাচ্ছিল- সরুচাকলি
১৪১) ‘প্রথম পিঠেখানা কানাচে ষাঁড়া ষষ্ঠীকে ফেলে দিয়ে আসি’ বলেছিল- পুঁটি
১৪২) ‘দিদি বড়ো ভালোবাসতো’- বক্তা হলো- পুঁটি
১৪৩) ‘অত ঘন করে ফেললে কেন?’ বলেছিল-রাধী
১৪৪) ‘উঁচু কথা কখনো কেউ শোনেনি’- যার সম্পর্কে বলা হয়েছিল- ক্ষেন্তি
১৪৫) শুকনো পাতায় খসখস করতে করতে ঘন ঝোপের মধ্যে ছুঁটে গিয়েছিল- শিয়াল
১৪৬) বিভূতিভূষণ বন্ধ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্প সংকলন হলো- মেঘমল্লার
১৪৭) পুঁইমাচা গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল- প্রবাসী পত্রিকায়
১৪৮) পুঁইমাচা গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল- ১৩৩১ বঙ্গাব্দে
১৪৯) পুঁইমাচা গল্পটি যে গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে- মেঘমল্লার
১৫০) পুঁইমাচা গল্পটি প্রথম গল্পগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল- ১৯৩১ খ্রিঃ
১৫১) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস- পথের পাঁচালী
১৫২) যে উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ রবীন্দ্র পুরষ্কার পান- ইচ্ছামতী
১৫৩) বিভূতিভূষণের একটি ভ্রমণ কাহিনী হল- অভিযাত্রিক
১৫৪) বিভূতিভূষণের একটি অভিযানমূলক কাহিনি হল- চাঁদের পাহাড়
১৫৫) পুঁইমাচা গল্পটি যে হাতে লেখা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়- অবসারিকা
পুঁইমাচা গল্পের সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর
১. পুঁই মাচা গল্পের লেখক কে ?
উত্তরঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২. পুঁই মাচা গল্পের উৎস কী ?
উত্তরঃ ‘মেঘমল্লার’ গল্পগ্রন্থ।
৩. গল্পের চরিত্রগুলোর নাম কী কী ?
উত্তরঃ সহারহরি চাটুজ্যে, তার স্ত্রী অন্নপূর্ণা, তাদের তিন মেয়ে ক্ষেন্তি, পুঁটি এবং রাধী। অন্যান্য চরিত্রগুলি হলো- কালীময় ঠাকুর, গয়া বুড়ী, রায় কাকা, দুর্গা, তারক খুড়ো, কেষ্ট মুখুজ্যে, বিষ্ণু সরকার, পরেমেশ্বর চাটুজ্যে এবং সুরেশ কাকা।
৪. সহায়হরি চাটুজ্যে স্ত্রীর কাছে কী চেয়েছিলেন এবং কেন ?
উত্তরঃ একটা বড় বাটি বা ঘটি, রস আনার জন্য চেয়েছিলেন।
৫. “একটু ভাল রস আনি” বক্তা কে ? কার কাছ থেকে তিনি রস আনবেন ?
উত্তরঃ বক্তা হলেন সহায়হরি চাটুজ্যে। তিনি তারক খুড়োর কাছ থেকে রস আনবেন।
৬. যখন সহায়হরি স্ত্রীর কাছে বাটি-ঘটি চেয়েছিলেন তখন তার স্ত্রী কোথায় বসে ছিলেন এবং কী করছিলেন ?
উত্তরঃ খড়ের রান্না ঘরের দাওয়ায় বসে ছিলেন, সময়টা ছিল শীতকাল। তিনি নারকেল তেলের বোতল থেকে ঝাঁটার কাটির সাহায্যে তেল তুলে মাথায় দিচ্ছিলেন।
৭. “এমনকি বিশেষ কোনো কোথাও বলিলেন না” কে ?
উত্তরঃ অন্নপূর্ণা।
৮. “তুমি তেল মেখে বুঝি ছোঁবে না ?” কে, কাকে কী ছোঁয়ার কথা বলেন ?
উত্তরঃ সহায়হরি স্ত্রী অন্নপূর্ণাকে এই কথা বলেন। বাটি-ঘটি ছোঁয়ার কথা বলেছেন।
৯. “গাঁয়ে কি গুজব রটেছে জান ?” কাকে, কে প্রশ্নটি করেন ? কী গুজব রটেছে ?
উত্তরঃ সহায়হরি তার স্ত্রী অন্নপূর্ণাকে প্রশ্নটি করেন। সহায়হরি বাগদী ও দুলেদের মতো নিচু জাতিদের সঙ্গে মিশে অচ্ছুত হয়েছেন। এদিকে তার বড় মেয়ের বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, একবার আশীর্বাদ হয়েও পাত্র পছন্দ না হওয়ায় বিয়ে ভেঙ্গে দেন সহায়হরি তাই তাকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করে এক ঘরে করা হবে এটাই গুজব উঠেছে। চৌধুরীদের চণ্ডীমণ্ডপে এই কথা আলোচনা হয়।
১০. “সমাজে থাকতে হলে সেই রকম মেনে চলতে হয়।” কে, কাকে এ কথা বলেন ? কী নিয়ম ?
উত্তরঃ অন্নপূর্ণা তার স্বামী সহায়হরিকে এ কথা বলেন। ব্রাহ্মণ সমাজে থাকলে গেলে বাগদী, দুলেদের মতো ছোট জাতদের সঙ্গে মেলামেশা করার নিয়ম নেই, এটাই নিয়ম।
১১. “অন্নপূর্ণা তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া উঠিলেন” কেন ?
উত্তরঃ সহায়হরি এক ঘরে করার কথাটা পাত্তাই দিলেন না তাই।
১২. “মুরোদ” শব্দের অর্থ কী ?
উত্তরঃ ক্ষমতা, সামার্থ্য।
১৩. “ধাড়ী মেয়ে” অর্থ কী ?
উত্তরঃ বয়স্ক মেয়ে।
১৪. “দাওয়া” শব্দটির অর্থ কী ?
উত্তরঃ বারান্দা।
১৫. “খিড়কী দুয়ার” কী ?
উত্তরঃ বাড়ির পেছন দিকের দরজা।
১৬. ক্ষেন্তির বয়স কত ?
উত্তরঃ চোদ্দ-পনেরো।
১৭. ক্ষেন্তির আনা পুঁই শাক কেমন ছিল ?
উত্তরঃ ডাঁটাগুলি মোটা ও হলদে, পাকা পুঁই গাছ।
১৮. ক্ষেন্তির চেহারা কেমন ছিল ?
উত্তরঃ লম্বা, গোলগাল, কালো চুল (কৃষ্ণ চুল), মুখমণ্ডল ও চোখ বড়।
১৯. সেফটিপিনটিকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কেন বলা হয়েছে ?
উত্তরঃ অনেক পুরানো তাই।
২০. “পুঁই পাতা জড়ানো কোনো দ্রব্য” কী দ্রব্য ?
উত্তরঃ চিংড়ি মাছ।
২১. ক্ষেন্তি কার কাছে চিংড়ি মাছ ও পুঁই শাক নিয়েছে ?
উত্তরঃ গয়া বুড়ীর কাছ থেকে চিংড়ি মাছ এবং রায় কাকার কাছ থেকে পুঁই শাক নিয়েছিল।
২২. অন্নপূর্ণা কাকে পুঁই শাকগুলো ফেলে দিতে বলেছিলেন ?
উত্তরঃ ছোট মেয়ে রাধীকে খিড়কীর পুকুরের ধারে ফেলে দিতে বলেছিলেন।
২৩. “মেয়ে মানুষের আবার অত নোলা কিসের !” ‘নোলা’ অর্থ কী ?
উত্তরঃ লোভ।
২৪. “তাহার চোখ দু’টা জলে ভরিয়া আসিয়াছে।” কার, কেন, চোখে জল এসেছে ?
উত্তরঃ ক্ষেন্তির চোখে জল এসেছে। মা অন্নপূর্ণা পুঁই শাকগুলো ফেলে দিতে বললে সে কেঁদে ফেলে।
২৫. “তার মনে বড় কষ্ট হইল।” কার মনে কেন কষ্ট হলো ?
উত্তরঃ সহায়হরির মনে কষ্ট হলো। মেয়ে ক্ষেন্তি অনেক সাধ করে পুঁই শাক এনেছে, সেগুলি অন্নপূর্ণা ফেলে দিতে বললে ক্ষেন্তির চোখে জল আসে। মেয়ের কান্না দেখে পিতা হিসাবে সহায়হরি মনে কষ্ট পান।
২৬. “ক্ষেন্তি আবদার করিয়া বলিয়াছিল-” কী বলেছিল ?
উত্তরঃ ‘মা, অর্ধেকগুলো কিন্তু একা আমার’- বলে পুঁই শাকের আবদার করেছিল।
২৭. “আনন্দপূর্ণ ডাগর চোখে মায়ের দিকে ভয়ে ভয়ে চাহিল।” কে, কেন ?
উত্তরঃ ক্ষেন্তি দুপুরবেলা খেতে বসে পাতে অপ্রত্যাশিত ভাবে পুঁই শাকের চচ্চড়ি দেখে বিস্মিত ও আনন্দিত হয়। কারণ, মানুষের দেওয়া পুঁই শাক এনে ক্ষেন্তি মায়ের বকুনি খেয়েছিল এবং মায়ের আদেশে সেই শাক ফেলে দিতে বাধ্য হয়, তাই খাওয়ার পাতে পুঁই শাক দেখে সে অবাক হয়ে যায়। সে পুঁই শাক খেতে খুব ভালোবাসে।
২৮. “কালীময়ের চণ্ডীমণ্ডবে সেদিন বৈকাল বেলা সহায়হরির ডাক পড়িল।” কেন তার ডাক পড়ল ?
উত্তরঃ মেয়ের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, তবুও সহায়হরি মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করছেন না। ব্রাহ্মণ সমাজে এটা এক ধরনের অপরাধ। সেটা শাসানির সুরে সহায়হরিকে স্মরণ করে দিতেই তাকে ডাকা হয়েছে চণ্ডীমণ্ডবে।
২৯. ক্ষেন্তির বিয়ে কার সঙ্গে ঠিক হয়েছিল ?
উত্তরঃ শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলের সঙ্গে।
৩০. “আশীর্বাদ হওয়াও যা বিয়ে হওয়াও তা”/”রাজপুত্তুর না হলে পাত্তর মেলে না ?” বক্তা কে ?
উত্তরঃ কালীময় ঠাকুর।
৩১. শ্রীমন্ত মজুমদারের বাড়ি কোথায় ছিল ?
উত্তরঃ মণিগাঁয়ে।
৩২. “ইহা দুষ্ট পক্ষের রটনা মাত্র।” কী ?
উত্তরঃ কালীময় শ্রীমন্ত মজুমদারের কাছে অনেক টাকা ধার করেছিলেন তাই সহায়হরির মেয়ের সঙ্গে মজুমদারের ছেলের বিয়ে ঠিক করে দেন।
৩৩. সহায়হরি কেন মেয়ের বিয়ে ভেঙে দেন ?
উত্তরঃ যে পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল সেই ছেলে এক কুম্ভকারবধূর আত্মীয়-স্বজনের হাতে মার খায়। সেজন্য সহায়হরি বিয়ে ভেঙ্গে দেন।
৩৪. ‘আতপ’ শব্দের অর্থ কী ?
উত্তরঃ রৌদ্র বা সূর্যের কিরণ।
৩৫. “বাবা, যাবে না ? মা ঘাটে গেল….।” কে, কাকে, কোথায় যেতে বলেছে ?
উত্তরঃ ক্ষেন্তি তার বাবাকে বরোজপোতার বনে মেটে আলু আনতে যেতে বলেছে।
৩৬. ‘সন্তর্পণে’ অর্থ কী ?
উত্তরঃ অতি সাবধানে, সতর্কতার সঙ্গে।
৩৭. “ইহারা কাহারো ঘরে সিঁধ দিবার উদ্দেশ্যে চলিয়াছে।” কারা, কী নিয়ে কোথায় যাচ্ছিল ?
উত্তরঃ ক্ষেন্তি এবং তার বাবা শাবল নিয়ে মেটে আলু আনতে যাচ্ছিল।
![]()