
“বাঙ্গালা ভাষা” – স্বামী বিবেকানন্দ
“বাঙ্গালা ভাষা” স্বামী বিবেকানন্দের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, যেখানে তিনি বাংলা ভাষার গুরুত্ব, তার ভবিষ্যৎ এবং উন্নতির পথ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
“বাঙ্গালা ভাষা” – প্রবন্ধটির মূল ভাব
স্বামী বিবেকানন্দ এই প্রবন্ধে বাংলা ভাষার প্রকৃত ভূমিকা ও শক্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ভাষার আসল কাজ হলো মানুষের ভাব প্রকাশ করা। কিন্তু আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কৃত ভাষাকে বিদ্যার বাহন করা হয়েছিল, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন ছিল। ফলে শিক্ষিত আর সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বড় দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তাই যাঁরা সত্যিকারের সমাজের উপকার করতে চেয়েছেন—যেমন বুদ্ধদেব, চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণ—তাঁরা সবসময় সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলেছেন, যাতে সবাই তা সহজে বুঝতে পারে।
স্বামীজী মনে করেন, আমাদের ভাষা সহজ, প্রাণবন্ত এবং স্বাভাবিক হওয়া উচিত। তিনি কৃত্রিম ও দুর্বোধ্য ভাষার বিরোধিতা করেছেন। অনেক সময় আমরা সাধারণ ভাষায় চিন্তা করি, কথা বলি, কিন্তু লেখার সময় খুব কঠিন ভাষা ব্যবহার করি, যা অপ্রয়োজনীয়। তিনি বলেছেন, যে ভাষায় আমরা মনের ভাব প্রকাশ করি, রাগ-দুঃখ প্রকাশ করি, সেটাই প্রকৃত ভাষা। কারণ সেটাই সবচেয়ে শক্তিশালী, নমনীয় এবং প্রাণবন্ত।
তিনি বাংলা ভাষার বিভিন্ন রূপ নিয়ে বলেছেন যে, কলকাতার ভাষা ধীরে ধীরে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ছে, তাই সেটাই ভবিষ্যতে সবার ভাষা হয়ে উঠবে। তাই লিখিত ভাষাও হওয়া উচিত সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য, যাতে বিদ্যা শুধু শিক্ষিতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং সাধারণ মানুষও তা বুঝতে পারে।
স্বামীজী আরও দেখিয়েছেন যে, ভাষার মতোই আমাদের শিল্প, সংগীত ও স্থাপত্যও একসময় বাহ্যিক চাকচিক্যের কারণে প্রাণ হারিয়েছিল। ভাষা কঠিন হয়ে গিয়েছিল, গান বোঝার চেয়ে জটিল হয়ে উঠেছিল, আর শিল্পকলা অতিরিক্ত অলংকরণের কারণে তার আসল সৌন্দর্য হারিয়েছিল। তিনি মনে করেন, ভাষা বা শিল্প তখনই উন্নত হয়, যখন তা মানুষের অনুভূতি ও ভাব প্রকাশের উপযোগী হয়।
সুতরাং, স্বামী বিবেকানন্দ এই প্রবন্ধে বুঝিয়েছেন যে, ভাষার আসল উদ্দেশ্য হলো মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করা। ভাষা যদি খুব বেশি কঠিন হয়, তাহলে তা প্রাণহীন হয়ে পড়ে এবং তার কার্যকারিতা হারায়। তাই ভাষাকে সহজ, স্বাভাবিক ও শক্তিশালী হতে হবে, যাতে তা মানুষের জীবন ও চিন্তাকে এগিয়ে নিতে পারে।
![]()